আমি নিমতিতা রাজবাড়ি। গঙ্গার প্রান্তে একশ পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস নিয়ে আমি এইভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। সময়ের বিবর্তনে আমি হারিয়েছি আমার যৌবনের সৌন্দর্য। বার্ধক্যের আবেগ স্পর্শ করেছে আমার এই শরীরকে। তার ছেঁড়া কোন সুর হারানো তানপুরার মতোই পড়ে রয়েছি আমি এই রাজবাড়ি। ভেঙে যাওয়া হাড় পাঁজরার মতোই ভেঙে পড়েছে আমার অহংকারের এই স্তম্ভ গুলি। ফাটল ধরতে শুরু করেছে আমার অমসৃণ জীর্ণ শরীরের দেওয়াল। নাম না জানা কতো রকমের গাছ আর লতাপাতা আঁকড়ে ধরে রয়েছে আমার এই নষ্ট শরীরকে। আস্তে আস্তে খসে পড়ছে আমার দেহের সৌন্দর্যের ওই প্যালেস্তারার নকশা গুলি। প্লাবিত গঙ্গার মাতাল ঢেউগুলি হরণ করেছে আমার তারুণ্যের সেই মাধুর্য। ধুলোতে মিশে গিয়েছে আমার জৌলুস আর জমিদারি আভিজাত্য। নড়বড়ে কড়ি বরগা, আর দুই প্রজন্মের স্মৃতি নিয়ে আমি আজও তোমাদের জন্মের আদিপ্রান্তে এইভাবেই দাড়িয়ে আছি। ভাঙা চোরা মন আর বলতে না পারা কোন নিরব অভিমান নিয়ে এইভাবেই বছরের পর বছর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছি আমি। পুজোর চারদিনের জন্যে আমার জনজীবনে বয়ে যায় এক আনন্দের জোয়ার। মা দুর্গার আরাধনার ঢাকের শব্দে ধনী, দরিদ্র, বৃদ্ধ, আর কচিকাচা দের আনন্দে ভরে ওঠে আমার এই আঙিনা। প্রানভরে ওরা দেখে আমার ধ্বংস প্রায় শৈল্পিক কারুকার্য, বিষ্ময় চোখে মেলাতে থাকে সেলুলয়েডের ফিতাতে দেখা আমার রুপের সেই নিদর্শন গুলিকে। মনে মনে ফিরে যেতে যায় বইয়ের পাতাতে পড়া অবসান হয়ে যাওয়া রাজতন্ত্রের সেই সব যুগে। তারপর আমাকে নিয়ে বিস্তর ছবি তোলা, কাগজে, ম্যাগাজিনে লেখালেখি, টেলিভিশনের খবর ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই করা হয়। মায়ের বিদায়ের সাথে সাথে আমার সদর দরজায় আবার এসে পড়ে আমাবস্যার কালো ঘোর অন্ধকার। আবার আমার ঘাড়ে ধীরে ধীরে ভর করতে শুরু করে একাকীত্বের দুঃখ। নিঃসঙ্গ জীবনের বুকের কোনেতে আবার একটু একটু করে জমতে থাকে একরাশ ব্যথা। এইভাবেই স্হির দৃষ্টিতে একমনে তাকিয়ে থাকি গঙ্গা নদীর দিকে আর অাশার দিন গুনে চলি। এতগুলো বছরে কতো শতো পরিবর্তন, ছলনা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, আর মানুষের অবহেলা পেয়ে পেয়ে হারিয়েছি আমি আমার গৌরবময় স্মৃতি গুলিকে। সময়ের ব্যস্ততা আর অর্থের প্রতিযোগীতা মানুষকে করে তুলেছে আরও নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর। কতো ঘটনার সাক্ষী আমি এই রাজবাড়ি। কতো মহান, জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির পদধূলি পড়েছে আমার এই আঙিনায় কতো সঙ্গীতের মূছৃনা লেগে রয়েছে আমার ওই দেওয়ালের গায়ে। তাদের সেই সব বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি দের কথোপকথনের সাক্ষী একমাত্র আমি ! শুধুই আমি! ধন্য আমি সেই সব ব্যাক্তিবগের পদধূলিতে। এখন আমার রুপের জৌলুস আর আগের মতো নেই। সমস্ত সৌন্দর্য হারিয়ে আজ আমি অসহায়। কিন্তু আমার আত্ম অহংকার এখনো একটুও কমেনি। এই আত্ম অহংকার নিয়েই আমি হাজার হাজার বছর পরেও ঠিক এইভাবেই দাড়িয়ে থাকবো। তখন তোমরা এসো আমার কাছে হয়তো বা কোন অশরীরী আত্মা হয়ে বা কোন গাঙচিলের বেশে। তখন না হয় আমি শোনাব আমার না বলা সেই সব পুরনো দিনের ইতিহাস ।
(ব্লগামী বিভাগে লেখা পাঠাতে চান, তাহলে Whatsapp +91 89613363755 এ মেসেজ করে বা আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ করে বা ই-মেলে raghunathganjtown@gmail এ পাঠাতে পারেন)
Post a Comment