FB.init({ appId : '{248591178890761}', status : true, xfbml : true, version : 'v2.7' // or v2.6, v2.5, v2.4, v2.3 }); FB.init() function onLogin(response) { if (response.status == 'connected') { FB.api('/me?fields=first_name', function(data) { var welcomeBlock = document.getElementById('fb-welcome'); welcomeBlock.innerHTML = 'Hello, ' + data.first_name + '!'; }); } } FB.getLoginStatus(function(response) { // Check login status on load, and if the user is // already logged in, go directly to the welcome message. if (response.status == 'connected') { onLogin(response); } else { // Otherwise, show Login dialog first. FB.login(function(response) { onLogin(response); }, {scope: 'user_friends, email'}); } }); দাদাঠাকুর ও ’জঙ্গিপুর সংবাদ’ | Raghunathganj - Jangipur
Menu

Admin Admin Author
Title: দাদাঠাকুর ও ’জঙ্গিপুর সংবাদ’
Author: Admin
Rating 5 of 5 Des:
‘‘আসল কথা অন্যায় যারা করে, তারা বেশ ভালোভাবেই জানে— পৃথিবীর মানুষ অন্যায়কে সমর্থন করবে না। তাই তারা কথার পর কথা সাজিয়ে, যুক্তির পর যু...

‘‘আসল কথা অন্যায় যারা করে, তারা বেশ ভালোভাবেই জানে— পৃথিবীর মানুষ অন্যায়কে সমর্থন করবে না। তাই তারা কথার পর কথা সাজিয়ে, যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে বহুভাবে বোঝাবার চেষ্টা করে যে, তাদের সমস্ত কাজই ন্যায়সঙ্গত। তারা মনে ভাবে পৃথিবীর মানুষগুলো সব নির্বোধ! — তারা কাজ দেখবে না কথাই শুধু শুনবে। তারা জানতে চাইবে না, পৃথিবীর মানুষ আজ কেন এত কষ্ট পায়! জানতে চাইবে না— যারা পৃথিবীতে ‘নূতন শৃঙ্খলা’ আনতে চায়, তাদের নিজের দেশের মানুষগুলোই অসীম দারিদ্র্যে কেন বিপর্যস্ত? কেন ইতালির পথেঘাঠে আজ ভিখারী ভিখারিণীর ভিড়? কেন জার্ম্মানির লোকগুলো আজ ক্রীতদাসের দুর্বহ জীবন যাপনে মুমূর্ষু? কেন জাপানের লোকগুলো আজ পশুর মত প্রতিবাসীদের গাত্রে আঁচড়াতে কামড়াতে হচ্ছে অভ্যস্ত?’’

এ রচনা কোনো বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের দীর্ঘ প্রবন্ধের অংশবিশেষ নয়— এটি এক‍‌টি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় রচনার অংশ। প্রকাশকাল ১৩৪৭বঙ্গাব্দ বা ১৯৩৯ সাল। সংবাদপত্রটি ছিলো সচিত্র সাপ্তাহিক। প্রকাশস্থল ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার রঘুনাথগঞ্জ শহর। পত্রিকার নাম ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’। সম্পাদক শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। বাংলাদেশে তাঁকে অবশ্য এনামে নয়, অধিকাংশ মানুষই চিনতেন ‘দাদাঠাকুর’ নামে, যে সম্পাদকীয় রচনার নির্বাচিত অংশটি উপরে উদ্ধৃত তাঁর শিরোনাম ‘শৃঙ্খলা না শৃঙ্খল’। প্রসঙ্গ অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।

রচনাটির সূত্রপাত হয়েছিল এভাবেই— ‘‘আধুনিক রাষ্ট্রনীতি বিজ্ঞানে পররাষ্ট্রনীতির প্রাধান্য বেশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি— অভিনব এ‍‌ই রহস্যময় কথাটা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সত্য কথা বলতে কী, কথাটার যথার্থ অর্থ আমি বুঝতে পারি না। আপন রাষ্ট্রের অর্থ বাণিজ্যাদির যোগসম্বন্ধ সুচারুরূপে নিয়ন্ত্রিত করবার এবং স্বাত্মার সহিত পরমাত্মার সর্ববিধ অধিকার স্বীকার করা ও করানোর নীতিকে পররাষ্ট্রনীতি বলবো, না আপন রাষ্ট্রের অস্ত্রবল ও লোকবলের সহায়তায় অন্যান্য রাষ্ট্রকে পদানত করবার এবং পদানত রাখবার কূটনীতি ও বীভৎস অভিলাষকে পররাষ্ট্রনীতি অ্যাখ্যা দেব?’’ ৭০বছর বাদেও পররাষ্ট্রনীতি শব্দটি নিয়ে দাদাঠাকুরের প্রশ্নের বা বিভ্রান্তির স্পষ্ট উত্তর মিললো না। সে সময়ে দাদাঠাকুরের সমালোচনার লক্ষ্য ছিলেন ‘হিটলারজী’। আজকে আপন শক্তির দম্ভে অন্ধ শক্তির নাম বদল হয়েছে মাত্র। কিন্তু চরিত্রগত কোনো বদল হয়নি। সেদিনও ফ্যাসিবাদী শক্তির বক্তব্য ছিল— ‘‘কথাটাকে বেশ সরলভাবে বলতে গেলে এই বলতে হয় যে, আজকালকার পৃথিবীরাষ্ট্রে সুখ নাই, শান্তি নাই, স্বাধীনতা নাই, প্রগতি নাই এবং সেই জন্যই নাকি তাঁদের আকস্মিক অভ্যুদয়। কেননা, তাঁদের মতে, অন্যান্য সকলে পৃথিবীটাকে উৎসন্নে দেবার চেষ্টা করছে— আর দুদিন চুপ করে থাকলে তারা পৃথিবীটাকে শ্মশান করে ছাড়বে। তাই তারা তিন বন্ধু — জাপান-জার্মানী-ইটালী একদা একত্র হয়ে ব্যথিত হৃদয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বললে— ‘‘এসো পৃথিবীকে বাঁচাই, বিশৃঙ্খল ও বন্দিনী পৃথিবীটার কানে, এসো নতুন শৃঙ্খলার এবং অপরূপ মুক্তির মন্ত্র দিই।’’

মন্ত্র বেরুলো। মন্ত্র বেরুলো ঋষিত্রয়ের আত্মা থেকে — নাজী মন্ত্র, ফ্যাসিস্ত মন্ত্র, মনরো মন্ত্র। সেই মন্ত্রের প্রধানতম নির্দেশ হলো— পরকে আপন করে আনা। শক্তিধর দেশগুলির এই জাতীয় জবানবন্দীর সঙ্গে ইতিহাস অতিপরিচিত। বক্তা বদল হয়, বদল হয় পরিপ্রেক্ষিত। বদল হয় উদ্দেশ্য। কখনও ভৌগোলিক সীমানার বিস্তৃতি, কখনও বা চোখ থাকে প্রাকৃতিক সম্পদে। কিন্তু এক থা‍কে দখলদারির মনোভাব, লুণ্ঠনের প্রকৃতি।

দাদাঠাকুরের রচনার অন্যতম অস্ত্র ছিল ব্যঙ্গ। তাই আগ্রাসনের বিবরণ দিতে গিয়েও তিনি বলে উঠলেন— ‘‘এশিয়ার ঋষি তাই ছুটলেন ‘মহাচীন’কে আপন করে নিতে— আর ইয়োরোপের ঋষিদ্বয়ের একজন চললেন আবিসিনিয়ার অর্ধসভ্য বর্বরদের চৈতন্যপ্রভুর জগাই মাধাইকে আলিঙ্গন দেবার মতই, আলিঙ্গন দানে সভ্য করে নিতে— তার অন্যজন ছুটলেন ম্যানকাইন্ড এর সেভিয়ারের মত সমগ্র ইয়োরোপকেই আপন আত্মার অভ্যন্তরে স্থান দিতে। নতুন শৃঙ্খলা আসতে তাই বাধ্য— নূতন নিয়ম, নূতন শান্তি, নূতন রূপ, নূতনতর আইন প্রবর্তিত হতে তাই বাধ্য।’’

আর এর ফলে— ‘‘মরে গেল পুরাতন আবিসিনিয়া— সম্রাট হাইলী সিলাসী ফকির হলো, ... মরে যেতে বসলো প্রাচীন চীন — নূতন শৃঙ্খলা গ্রহণের আইন অমান্য করতে চাইলো বলে, খেলো গোলা আর গুলি, পেলো উড়োজাহাজের হুড়ো আর বোমাবৃষ্টির চোখরাঙানি। পুরাতন চেক, পুরাতন বেলজিয়াম, পুরাতন হল্যান্ড, পোল্যান্ড ফ্রান্স মরে গেল, একেবারে মরে গেল।’’

আর ‘‘দেখা গেল— নূতন শৃঙ্খলা শৃঙ্খলে আবদ্ধ (ঐক্যবদ্ধ?) নাজীরাষ্ট্র মোষের মত খাটতে লাগলো, খেতে লাগলো হিটলারের গোত্তা। কিন্তু অন্নভাবে, অর্থাভাবে, মুক্ত বাতাসের অভাবে তারা একেবারে যে ম‍লো তা নয়— তারা বেঁচেই রইলো। হিটলারের গোত্তা খেয়ে কি বাঁচা যায়? হিটলারীয় শৃঙ্খলাস্তব্ধ নাজীরাষ্ট্রগুলির মানুষগুলোও ধুকতে ধুকতেও বেঁচে আছে দেখে মনে হয় হিটলারের গোত্তায় সম্ভবতঃ না খেয়েও বাঁচবার অলৌকিক কোন ‍ মেডিসিন বা ভিটামিন আছে।’’

কিন্তু যেখানে মানবসভ্যতার মৌলিকনীতি আক্রান্ত সেখানে কোনো সংবেদনশীল হৃদয় লঘু রসিকতা করতে পারে না। তখন তীব্র হয়ে ওঠে প্রতিবাদ। আক্রান্ত এবং প্রতিবাদকারীর ‍ভৌ‍‌গোলিক দূরত্ব তখন বিবেচিত হয় না— প্রতিবাদের প্রভাব কতটা আক্রমণকারীকে স্পর্শ করবে তাও বিবেচনায় আসে না। কারণ এ সময়ে প্রতিবাদ না করাটাই অপরাধ। দাদাঠাকুর লিখছেন — ‘‘যেখানে জ্বালা, যেখানে অবসান— যেখানে অর্থহীন, অন্নহীন, শান্তিহীন, মর্মদাহন— যেখানে মুক্তিবিহীন নিরানন্দ অন্ধকারে সরীসৃপের মতো জীবনযাপনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা — সেখানে রসিকতার স্থান নাই, স্থান নাই হাস্য পরিহাসের। শৃঙ্খলা, স্বাধীনতা, শান্তি ও প্রগতি এনে দেবার প্রচার কার্য্যের অন্তরালে যারা দেশের ও বিদেশের সর্বাধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হরণ করছে নির্মমের মত, তাদের কথার ও কার্যসমূহের সমালোচনা প্রসঙ্গে রসরচনা সমীচিন হয়। ভারতবর্ষের মানুষ নিজের দুঃখেই শুধু অশ্রু ফেলে না, যারা নিপীড়িত, যারা শৃঙ্খলিত, যারা অতিবেদন ও দারিদ্র্যদুঃখে নিত্য বিপর্যস্ত, ভারতবর্ষ তাদের দুঃখেও অশ্রু ফেলতে জানে। স্বৈরতন্ত্রী জাপানের নিত্য নিপীড়নে চীনের যে ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন, ভারতবর্ষ তাতে ব্যথিত না হয়ে পারে না, জাপানের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে, প্রচারকার্য পরিচালন করতেও পশ্চাদপদ হয় না।’’

যারা নিজেদের দেশের সমস্যা সমাধানেই ব্যর্থ তারা যখন আজও অন্য দেশের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক’ উদ্যোগ নেয় তখন বারে বারে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হয়। ‘‘নিজেদের ঘর সামলাতে যারা এনে দিতে পারে না শান্তি, তারা অন্য ঘরে এনে দেবে শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি আর প্রগতি। হাসি পায়। হাসির সঙ্গে বিষাক্ত হয়ে ওঠে চিত্ত। যারা স্বাধীন চিন্তাশীল মনীষীদের দেয় না সম্মান, রফা করে না ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মানুষকে করে তোলে প্রাণহীন কলের স্তম্ভ, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রভুত্ব সংরক্ষণই যাদের পররাষ্ট্রনীতি — যারা প্রতিবাসী রাষ্ট্রের লুণ্ঠন করে যায় অর্থ, নারী, গৃহ, গৃহের আসবাব— পদতলে পিষ্ট করে যায় সমগ্র জাতীয় স্বার্থ ও শান্তি— তারা আনবে নূতন শৃঙ্খলা, নূতন স্বাধীনতা!’

সমসাময়িক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করার পর সম্পাদক মন্তব্য করেন — ‘‘স্বেচ্ছাচারী হিটলার যা করছে, স্বেরতন্ত্রী মুসোলিনী যা কর‍‌ছে কুপরামর্শশ্রয়ী মিকাডো— তার সমর্থনে ভারতবর্ষ একটা কথাও বলবে না। যারা সত্যসত্যই পৃথিবীর সর্বত্র শান্তি এনে দিতে চাইবে, ‍এনে দিতে চাইবে গণতান্ত্রিক সত্যকার স্বাধীনতা, যাদের পররাষ্ট্রনীতি লুণ্ঠননীতির নামান্তর নয়, তারাই শুধু গর্ব করতে পারে পৃথিবীতে নূতন শৃঙ্খলা আনতে পারে বলে। ভারতবর্ষ বিশ্বাস করে— সত্যেরই শুধু জয় হয়। অসত্য তার জয় হবে না। মিথ্যা ধাপ্পাবাজীর দ্বারা বাজীমাত করতে আসছে, তারা যেই হোক, ঈশ্বর তাদের সহায়ক হতে পারেন না।’’

সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং যুদ্ধ নিয়ে দাদাঠাকুরের সম্পাদক হিসাবে প্রতিবাদ এই প্রথম নয়। ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’। সে সময়ে চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। পত্রিকার ১ম বর্ষের ১৪তম সংখ্যা যা ২রা ভাদ্র ১৩২১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তাতে ‘ইউরোপ’ শীর্ষক সংবাদে লেখা হয়েছিলো— ‘‘যুদ্ধ— জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্ব্বত্রই জার্মানির সহিত অপরাপর রাজশক্তি অল্পবিস্তর সংঘর্ষ হ‍ইতেছে। জার্মানি কিন্তু কোথাও বড় সুবিধা করিতে পারিতেছেন না।’’

ঐ সংখ্যায় ‘সময়ের কথা’ শিরোনামে ‘দাদাঠাকুরের পত্র’ প্রকাশিত হয়। সে পত্রে সমসাময়িক সংবাদপত্রে যুদ্ধের সংবাদের আধিক্য ও তার প্রভাবে বাজার দরে আগুন নিয়ে সমালোচনা করেন। ‘‘তোমরা রাম না জন্মাতেই রামায়ণ প্রস্তুত কর। ভাবী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করিয়া নিজেদের ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা প্রমাণ করিতেছ। আচ্ছা যুদ্ধ বাধিল। তাতে তোমাদের দেশ হইতে চাল কলাই লইয়া গিয়া কি যুদ্ধের রসদ হইবে। তা যদি না হয় তোমাদের চালে ডালে খিচুরী কে ঘুচাবে ভাই? তবে অত ভাবনা কেন? মায়ের কোলের ছেলে কি কখন শত্রুকে ভয় করে? .... শুধু শুধু হাবা জুজুর ভয় দেখাইয়া দেশের লোককে ভীত করিও না। জার্মানি যেমন বেগে উঠিয়াছে তেমনি বেগে পড়িবেন। মেয়েরা বলে ‘‘অতি বড় হয়ো না ঝড়ে ভেঙ্গে যাবে। অ‍‌তি ‍ছোট হয়োনা ছাগলে মুড়ে খাবে।’’ এই স্ত্রীবাক্য কি একেবারে মিথ্যে হবে? তাই বলি সম্পাদক ভায়া যুদ্ধ যুদ্ধ করে কাগজখানা পূর্ণ করবার চেষ্টা করিও না। অন্য কিছু লেখ আর দেশের নিরক্ষর লোকদিগকে মা‍‌ভৈঃ মাভৈঃ বলিয়া সাহস দাও।’’

পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যা যা ৯ই ভাদ্র প্রকাশিত হয় তাতে টুকরো সংবাদ ছিল। ‘‘ইউরোপীয় সমরের হুজুগে অনর্থক দোকানদারগণ অনেক বেশী দামে জিনিস বিক্রয়ের চেষ্টা করিতেছে। তাই জঙ্গিপুর মহকুমার সবডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় তাঁহার এলাকার ব্যবসায়ীগণের বাজারদর ঠিক রাখিবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন।’’

ঐ সংখ্যাতেই ‘সমর সংবাদ’ নামে একটি নতুন বিভাগ চালু হয়। সেখানেই লেখা হয়— ‘‘শুনা যাইতেছে জার্ম্মানিতে শীঘ্রই খাদ্যাভাব উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। রুশিয়ার নিকট অস্ট্রীয়া নানা স্থানে পরাস্ত হইয়া রণেভঙ্গ দিয়াছে। জার্মানেরা নাকি ব্রাসেলস নগরবাসী প্রজার উপর অত্যাচার করিতেছে। শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া নিরীহ প্রজার উপর অত্যাচার কেন? এ কি রাজধর্ম? ধ্বংসের পূর্বে পাপ বৃদ্ধি প্রবল হইয়া থাকে? পাপপূর্ণ না হইলে ত ধ্বংস হইবে না।’’

পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়— ‘‘পৃথিবীতে শান্তিস্থাপন ও ইংরাজ রাজের বর্তমান ইউরোপীয় মহা সমরে জয়লাভের কামনায় কালীঘাটের সেবাইতরা কালীমাতার পূজা দিয়াছিলেন, জস্টিস্‌ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ হাইকোর্টের বাঙালী জজেরা এবং পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মিঃ পেইন, মিঃ প্যানটন প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। পণ্ডিত লক্ষণ শাস্ত্রী মহাশয় বৈদিক মন্ত্রগান করিয়াছিলেন।’’

ঐ সংখ্যার সমরসংবাদে মন্তব্য করা হয়— ‘‘জার্ম্মানির শত্রুর অভাব নাই। দুনিয়া যার দুসমন সে যতই পরাক্রান্ত হউক না কেন কখনই সফলকাম হইতে পারিবে না। জার্ম্মানির জলে কুমীর ডাঙ্গায় বাঘ হইয়াছে দেখিতেছি। স্থলে রুশিয়গণ বিপুল বিক্রমে জার্ম্মানির মধ্যে ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে। জলে ফরাসীরা বিপুল নৌবাহিনী তাদের সহায় জলযুদ্ধে চিরপ্রসিদ্ধ ইংরাজের অজেয় বাহিনী।’’

১৩২৯ বঙ্গাব্দ বা ১৯২২ সালে দাদাঠাকুর প্রকাশ করেন ‘বিদূষক’। প্রকাশিত হতো প্রতি শনিবার। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে প্রকাশের দিনটি হয় সোমবার। অল্পদিনেই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্যই এই পত্রিকা প্রধানত কলকাতায় জনপ্রিয় হয়। ১৩৩১ এর ৭ই বৈশাখ পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবী তখন কিছুটা শান্ত। প্যারিসের শান্তি সম্মেলন নামক অশান্তির গর্ভসঞ্চারের সাময়িক ফলশ্রুতিতে জার্মানির প্রতাপ তখন নিয়ন্ত্রিত। ‘বিদূষক’ পত্রিকাতে প্রধানতঃ কলকাতা তথা দেশের সংবাদই প্রধান্য পেত। তারই মধ্যে ৮ই ভাদ্র, ১৩৩১ এ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়—

সন্ধির সার্ত

জার্ম্মানির আর,

এরোপ্লেন রাখা

হইল ভার।

বুদ্ধি করিয়া

তাই সে আজ,

জব্দ করিল

উড়োজাহাজ,

যন্ত্র একটি

করেছে তোফা,

এরোপ্লেনের

দফাটি রফা,

আকাশে দেখিলে

এরোপ্লেনে,

মাটিতে তাহারে

আনিবে টেনে।

স্বদেশের নানা প্রশ্নেই দাদাঠাকুর বেশী গুরুত্ব দিতেন। এর কারণ ছিল তাঁর পাঠক ছিলেন প্রধানত মহকুমা শহর ও তৎসন্নিহিত মফঃস্বলের মানুষ। তারা প্রধানত দেশের খবর পড়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ পত্রিকাতে আন্তর্জাতিক সংবাদ বেশি গুরুত্ব পেত না। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নিজ মতামত প্রকাশে দাদাঠাকুর ছিলেন দ্বিধাহীন। আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ ও সমাজ্যবাদ-বিরোধি রচনায় সেই প্রবণতাই স্পষ্ট। যখনই কোনো দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতার অধিকার আক্রান্ত হয়েছে তখনই পত্রিকার পাতাতে সরব হয়েছেন দাদাঠাকুর। আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন ও নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে সম্পাদকীয় রচনা করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য, একটি প্রবন্ধ— ‘স্বরাজ ও জাতিভেদ’, প্রবন্ধের প্রসঙ্গ ছিলো ভারত যে স্বরাজলাভের অনুপযুক্ত এ জাতীয় অপপ্রচারের যুক্তিসংগত জবাব, সে জবাব দেবার জন্য দাদাঠাকুর আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে ও উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন। আমেরিকা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য— ‘‘জাতি ও ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও আমেরিকা আজ স্বাধীনতার লীলাভূমি, সভ্যজাতীর আদর্শস্থানীয়, পরাক্রমে জাতি সঙ্ঘের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া আছে।’’ গ্রেট ব্রিটেন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন— ‘‘ভাষায়, আচার ব্যবহারে, চালচলনে— ইংরাজ, স্বর, ওয়েলস্‌ ও আইরিশদিগের মধ্যে সৌসাদৃশ্য নাই, তবুও তো গ্রেট ব্রিটেন নিজের দেশের স্বাধীনতা বজায় রাখিয়া ‘অর্দ্ধজগতকে নিজের পতাকাতলে আনিতে সক্ষম হইয়াছে।’’ রাশিয়া প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য— ‘‘রাশিয়া-তে রাশিয়ার নামে আজ জগতের ধনীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়া ওঠে — সেই রাশিয়ায় কি এক‍‌টি জাতির বাস? অসংখ্য জাতির বাস ও অসংখ্য ভাষার প্রচলন সত্ত্বেও জগতের মধ্যে রাশিয়াই কেবল ধনসমতা স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছে— সেই কেবল ধনীপীড়িত বসুন্ধরার মুক্তির জন্য অগ্রসর হইয়াছে। তাহার পক্ষ হয়তো সর্বজনানুমোদিত না হইতে পারে, কিন্তু সে যে যথেচ্ছাচারকে উৎখাত করিয়া প্রকৃত সাম্যের প্রতিষ্ঠার কাজ করিয়াছে তাহা প্রত্যেক পীড়িত জাতিই স্বীকার করিবে।’’

প্রবন্ধটির প্রকাশকাল ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ বা ১৯২৯ সাল। প্রকাশিত হয় ১৬শ বর্ষের ১৩তম সংখ্যায়।

আসলে ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনেও দাদাঠাকুর ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। তাঁর জীবন ও রচনায় বারে বারে মানুষ হিসাবে স্বাধীন ও স্বকীয় অস্তিত্বরক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রধান কাজই হলো কোনো ব্যক্তি বা দেশের স্বাধীনতা হরণ করা, কাজেই নীতিগত প্রশ্নেই দাদাঠাকুর সাম্রাজ্যবাদের বিরোধি ছিলেন। যদিও তাঁর সেই ‍বিরোধিতা প্রকাশের সুযোগ ছিল সীমিত। তবুও সীমিত সেই সুযোগেই পরাধীন ভারতের শাসন কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি যে প্রতিবাদী সত্ত্বার আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিলেন তা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। সাংবাদিক হিসাবে দাদাঠাকুর সে অর্থে খুবই বহুল চর্চিত চরিত্র নন। ভারতের সাংবাদিকতার ইতিহাসের বইতে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর নামও উল্লেখিত নয়। কারণ হয়ত মফ্ঃস্বল কেন্দ্রিকতা। তবে এটাও উল্লেখ্য যে, একটানা কোনো বিরতি ছাড়া ১০০ বছর ধরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসাবে ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ গৌরবান্বিত হতে চলেছে। ইতিহাস সাংবাদিক হিসাবে দাদাঠাকুরের যথার্থ মূল্যায়ন না করলেও ধারাবাহিকতার গুণেই ইতিহাসে স্থান পাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’।

কৃতজ্ঞতা: কৃশানু ভট্টাচার্য

About Author

Advertisement

Post a Comment

Motion Post

 
Top